Parveen20160308055504

এক মনে ফুলের তোড়া সাজিয়ে যাচ্ছেন। পাতা ফেলছেন, আগাছা ছাঁটছেন। সুন্দর করে সুতায় বেঁধে ৫/৭ টি করে ফুলের সন্নিবেশে তৈরি করে চলেছেন পারভীন বেগম। যানজট কিংবা সিগন্যালের কারণে রাস্তার গাড়ি দাঁড়াতেই ছোট্ট ছেলে ছুট দিচ্ছে। ‘ফুলের মালা নিবেন বাইয়া মালা, ফুলের তোড়া নিবেন বাই।’

মা পারভীন বেগমের ছেলে মমিনুলকে নিয়ে এভাবেই বেঁচে থাকা। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ের খেজুরবাগান সংলগ্ন এলাকায় ফুল বিক্রি করেই জীবন চলে তার।

সোমবার জাগো নিউজের ক্যামেরায় ধরা পড়েন তিনি। পরে কথা বলে জানা যায় তার সংগ্রামী জীবনের কথা।

তিনি বলেন, আগারগাঁও এলাকায় পাইকারি দরে ফুল কেনেন তিনি। এরপর সে ফুল দিয়ে মালা, তোড়া সাজিয়ে বিক্রি করেন। ফুলের মান ও আকার অনুযায়ী বিভিন্ন দামে বিক্রি করেন। থাকেন রাজধানীর শেরে বাংলানগর থানাধীন বিএনপি বাজার মোড় এলাকায়।

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস আপনি জানেন? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। পরক্ষণে বললেন, ‘কিয়ের নারী দিবস? নারীগো আবার দিবস আছে নি বাংলাদেশে?’

এই প্রতিবেদক নারী দিবসের বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে তিনি নিজের সংগ্রামী জীবনের গল্প বলা শুরু করেন। অভাব আর দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত এই নারী জানান, অল্প বয়সে বাবা মা-বিয়ে দিয়েছিল। অল্প বয়সেই বিধবা হই। এরপর ছন্নছাড়া জীবন। মা-বাবাও আর বেঁচে নেই। ভাইরাও দায়িত্ব নিতে চায় নি। বেঁচে থাকার তাগিদেই ১৫ বছর আগে ঢাকায় আসা।

তিনি বলেন, বিধবার জীবন। সবাই টিটকারি মেরেছে। প্রথমে বাসায় ঝিয়ের কাজ করেছি। এরপর গার্মেন্টস। সব জায়গাতেই পুরুষের নির্যাতন। কেউ আমার দায়িত্ব নিতে চায় না। শরীরটা তখন ভালেই ছিল। সবারই চোখ ছিল শরীরে।

পারভীন জানান, নিজের নিরাপত্তা ও আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য অনেকটা অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও ১০ বছর কম বয়সী ছেলেকে বিয়ে করি। নতুন সংসারে ছেলে রয়েছে। নাম মমিন। স্বামী ও স্ত্রী মিলেই এখন ফুল বিক্রি করি। ছেলে মমিনের বয়স অল্প হলেও ফুল বিক্রিতে সহযোগিতা করে।

নারীর ক্ষমতায়ন অধিকার, নিরাপত্তা ও মর্যাদার বিষয়টি খুব একটা গ্রাহ্য করেন না পারভীন। তিনি বলেন, ‘যেখানে নিজের পেট চলে না সেখানে ক্ষমতা, মর্যাদা ও দিবস দিয়া আমি কি করমু। ওইসব দিবস কি আর আমাগো ভাগ্য বদলাইবো?’

এমন করুণ প্রশ্নের পর পারভীন আরো বলেন, ‘ভাই, সব নারী কি চায় জানেন? নিরাপদ ও ঝুঁকিহীন বালোবাসার (ভালোবাসার) সংসার। বালোবাসা থাউক বা না থাউক এহন আমার নিরাপত্তা আছে। টিয়ার কষ্ট (আর্থিক অনটন) থাকলেও খেয়ে-পড়ে বেঁচে আছি।’

নারী ও পুরুষ যে মর্যাদায় এবং অধিকারে সমান তা কখনোই কার্যত পায়নি এ শ্রমজীবী নারী। অল্প হলেও শিক্ষিতা পারভীন বলেন, ‘আমি একাই কামাই করি না। স্বামীও করে। আমার রোজগারে সংসার আর স্বামীর রোজগার যায় জুয়ায়। কিছু কইতে পারি না। না জানি আবার সংসার যায়। বয়স ভারি হচ্ছে বাকি জীবন আবার ঝুঁকিতে পড়লে রাস্তায় মরতে হবে যে।’

পারভীনের কথার মাঝেই হাজির হয় স্বামী আবু রায়হান মিয়া। দেখলেই বোঝা যায় স্বামী ও স্ত্রীর বয়সের কতো পার্থক্য! কিন্তু কি বা করার আছে এই শ্রমজীবী নারীর। তার রোজগারে সংসার চলে। স্বামীর খাম খেয়ালিপনাতেও সংসার ছাড়া করতে পারেনি পারভীনকে।

ফেরার পথে ভাবনা খেলা করছিল- ‘ইস পারভীনদের শ্রম আর সংসারী মনের দাম যদি রায়হানরা দিতে পারতো!’