ছবি: এলো প্রতিবাদে প্রতিরোধের উত্তাল অগ্নিঝরা মার্চ

ছবি: এলো প্রতিবাদে প্রতিরোধের উত্তাল অগ্নিঝরা মার্চ

 ভাষার মাস শেষ হতে না হতেই এল আগুন ঝরানো মার্চ। ১৯৭১ সালে এ মাসে শুরু হওয়া তীব্র ও উত্তাল আন্দোলনের মধ্যেই সূচিত হয় চূড়ান্ত স্বাধীনতা সংগ্রামের। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে এ মাসেই। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের।

এটিই আমাদের স্বাধীনতার মাস। আসলে ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই স্বাধীনতার সূর্য উঠেছিল। অধিকার বুঝে নিতে জেগে উঠেছিল এ দেশের মুক্তিকামী কোটি জনতা। একাত্তরের মার্চ ছিল মুক্তিকামী জনতার আন্দোলনে উত্তাল। বাংলা ছিল অগ্নিগর্ভ। ঢাকা জুড়েই স্লোগান আর স্লোগান। ‘জাগো জাগো, বাঙালী জাগো’, ‘পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘তুমি কে আমি কে, বাঙালী বাঙালী’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধরো-সোনার বাংলা মুক্ত করো’, ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা-ঢাকা’, ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা-বাংলা’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ এমন হাজারো স্লোগানে ঢাকাসহ উত্তাল সারাদেশ।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, এদিন পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণে ৩ মার্চে অনুষ্ঠেয় গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেন। এদিন বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে (তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়াম) বিশ্ব একাদশ বনাম পাকিস্তানের ক্রিকেট খেলা চলছিল। বেতারে ইয়াহিয়া খানের এ ভাষণ শুনে দর্শক স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। একই সময় পল্টন-গুলিস্তানে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্য সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটে এ মাসেই।

দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের। এ মাসের ৭ তারিখ ঐতিহাসিক তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে, বর্তমানে যোট সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম…। ১ মার্চ মতিঝিল-দিলকুশা এলাকার পূর্বাণী হোটেলে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।

ক্ষুব্ধ ছাত্ররা সেখানে গিয়ে প্রথমবারের মতো স্লোগান দেয়, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ছাত্ররা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে কর্মসূচি ঘোষণার দাবি জানান। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ সারা দেশ। আর কোনো আলোচনা নয়, পাকিস্তানি হানাদারদের সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তোলার দাবি ক্রমে বেগবান হতে থাকে। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ২ ও ৩ মার্চ তৎকালীন পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন। একই সঙ্গে তিনি ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন।

এ সময় পাকিস্তানি শাসকদের হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। মরতে যখন শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।

রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।’

বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। স্বাধীনতার আহ্বানে দেশবাসী এক হয়। এরই মধ্যে নানা কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র চালাতে থাকে তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা করতে থাকে। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার নামে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে।

এভাবেই আসে ২৫ মার্চ। কালরাত্রি। পাক হানাদার বাহিনীর ভারি অস্ত্র, কামান নিয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’র নামে এ দেশের ছাত্র-জনতাসহ নিরীহ বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। রাতেই বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে গর্জে ওঠে গোটা জাতি।

যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে তারা শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য ঘর হতে বেরিয়ে যায়। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, অগ্নিঝরা দিন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এই পথ ধরে বাংলার দামাল ছেলেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনেন একটি স্বাধীন দেশ -আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। তাই একাত্তরের মার্চ ছিল অগ্নিগর্ভ। যে আগুন শত জুলুম নির্যাতনেও ছিল অপ্রতিরোধ্য।

একাত্তরের এই মার্চ মাসেই প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়; পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার। একই সঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ঘোষণা করা হয়। অত্যাচার, নিপীড়ন আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে স্মারক মাস হিসেবে মার্চ প্রতিবারই আমাদের নতুন করে পথ দেখায়। আমরা আজকের দিনে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি সেই বীর শহীদদের, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের মূল্যবান জীবন দান করে প্রতিরোধ সংগ্রামে প্রেরণা যুগিয়েছিলেন।