anwar

আনোয়ারুল হক আনোয়ার :
১৯৯৬ সালে কলকাতাগামী বিমানে আমার পাশের সীটে বসা এক ব্যবসায়ী। তার বাড়ী মুর্শিদাবাদ জেলায়। পরিবার নিয়ে কলকাতায় থাকে। ত্রিশ মিনিটের আকাশ ভ্রমনে তার সাথে আন্তর্জাতিকসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হয়। জাতিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও বেশ স্পষ্টবাদী মনে হয়েছে। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর প্রচুর জ্ঞান রাখে। দমদম অবতরনের পর বিমান থেকে নেমে ইমিগ্রেশন বিভাগের উদ্দেশ্যে যাবার সময় ভদ্রলোক আমাকে কয়েকটি উদাহরন দিয়ে কানে কানে বলল, তোমাদের পতনের জন্য-তোমরা নিজেরাই দায়ী। এখন মনে পড়ছে, লোকটি সঠিক কথাটা বলেছে। আজ মুসলিম বিশে^র দিকে তাকালে ভদ্রলোকটির কথা বার বার মনে পড়ছে।

এক সময় মুসলমানরা ধর্ম, শিক্ষা, বিজ্ঞান, সাংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভ্রাতৃত্ব, জ্ঞান চর্চা ও সম্পদের নিরিখে অ-প্রতিদ্বন্ধী থাকলেও এক শ্রেনীর বিপদগামী মুসলমানের ষড়যন্ত্রের কারনে স্বীয় জাতির বিরুদ্বে ষড়যন্ত্র চলছে। অবস্থা এমনই যে, অন্য ধর্মাবলম্বীদের দৃষ্টিতে আজ মুসলমানরা জঙ্গী, বোমাবাজ ও হামলাকারী জাতি।

13690879_1734026963518811_5699584117724814522_n
কয়েকটি মুসলিম দেশের বর্তমান পরিস্থিতি : প্যালেস্টাইন, আফগান, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, মিশর, তুরস্ক, তিউনেশিয়া, নাইজেরিয়া, সোমালিয়া, পাকিস্তান, ইয়েমেন ও বাংলাদেশ আজ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের শিকার। এছাড়া প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে আরো কোন না কোন মুসলিম দেশের নাম।

কারা দায়ী ? অনেকের মতে, এসব অঘটনের জন্য বৃটিশ-মার্কিন ও মোশাদ দায়ী। তাদের যুক্তি হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর ফিলিস্তিনী ভূমি দখল করে সেখানে অবৈধভাবে ইহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলমানদের বিরুদ্বে বহুমুখী ষড়যন্ত্র শুরু হয়।

প্রভাবশালী মুসলিম দেশ বনাম পশ্চিমা সম্পর্ক ঃ মধ্যপ্রাচ্যের অধিকাংশ দেশের সাথে পশ্চিমাদের সম্পর্ক হিমালয় সমতূল্য। ব্যবসা, বানিজ্য, বিনিয়োগ, পর্যটন, প্রতিরক্ষা ও সামরিক ঘাঁটি স্থাপনসহ শত শত চুক্তি রয়েছে। বিনিময়ে পশ্চিমারা এসব দেশ থেকে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিচ্ছে। পবিত্র মক্কা ও মদীনা শরীফের সুবাদে সৌদী আরবকে মুসলমানরা সমীহ করে এছাড়া উপসাগরীয় ৬টি দেশের মুরুব্বী হিসেবেও সৌদী আরবের দারুন প্রভাব রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে উপসাগরীয় দেশগুলো সৌদী আরবের পরামর্শ গ্রহন করে। এদের সাথে ইসরাইলেরও সূ-সম্পর্ক রয়েছে। তুরস্ক ও মিশরের সাথে ইসরাইলের সম্পর্ক কারো অজানা নয়। ইসরাইলের সরকারী কর্তা ব্যক্তিরা প্রায়ই এসব দেশ সফর করে থাকে।

সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের উত্থান : তৎকালীন সৌভিয়েত-আফগান যুদ্বের মাধ্যমে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের সৃষ্টি। সিআইএ ও পাক সরকারের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে আল কায়েদা ও তালেবানের সৃষ্টি হয়। উপসাগরীয় কয়েকটি দেশ এজন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। অপরদিকে আফ্রিকা মহাদেশের নাইজেরিয়া ও সোমালিয়াসহ ৮টি দেশের জঙ্গী গোষ্ঠী যথাক্রমে বোকো হারাম, আনসার আল-ইসলামের উত্থানেও এদের সম্পৃক্ততার কথা সকলের জানা যায়।

আইএস এর উত্থান : ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের পরাজয়ের পর পলাতক সামরিক লোকজনকে সংগঠিত করে সিআইএ ও মোশাদের সার্বিক তত্বাবধান এবং সৌদী আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতায় ভয়ঙ্কর গোষ্ঠীটির জন্ম। উদ্দেশ্য ছিল, ইরাক, ইরান ও সিরিয়ার বিশাল অংশে (তাদের ভাষায়) ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা। অপরদিকে ইরাক ও সিরিয়া যুদ্বে আহত আইএস জঙ্গীদের চিকিৎসায় ইসরাইল গোলান উপত্যাকায় কয়েকটি ফিল্ড হাসপাতাল চালু করেছে। যুদ্বাহতদের ইসরাইলী সামরিক মেডিকেল কোর চিকিৎসা দিয়ে আসছে।

ইসলাম বিরোধী ও ওহাবীদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে (১) শিয়া অধ্যুষিত ইরাক, সিরিয়া ও ইরান হচ্ছে ইসরাইলের জাত শত্রু।
(২) ফিলিস্তিনী জনগনের সংগ্রামে এসব দেশ সমর্থন যুগিয়ে আসছে।
(৩) ইরাক, সিরিয়া ও ইরানের জনগন রাজতন্ত্র বিরোধী।
(৪) ইরান মধ্যপ্রাচ্যে পরাশক্তি হিসেবে বলীয়ান হচ্ছে ফলে রাজতন্ত্রের বারোটা বাজবে।
( ৫) মধ্যপ্রাচ্যে আইএস সফল হলে অন্যান্য মসলিম দেশেও এ্যাকশন শুরু হবে।
(৬) ১৯৮১ সালে মার্কিন সমর্থিত সরকারকে হটিয়ে ইরানে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত ঘটনায় বেজায় ক্ষুব্দ আমেরিকা। তাই ইরানের বিরুদ্বে প্রতিশোধ গ্রহনে মরিয়া হয়ে উঠেছে মার্কিনীরা।
(৭) মুসলমানদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি করে সর্বত্র যুদ্ব, সংঘাত ও হানাহানি বৃদ্বি করা।

কথায় বলে, অন্ধকারের পর আলো আসে। ঠিক তেমনিভাবে বিশ্বের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøামিদির পুতিন ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্বে বীরদর্পে আর্বিভূত হন। সাঁড়াশী অভিযানের মাধ্যমে আইএস এর কোমর ভেঙ্গে দিয়েছে রাশিয়ান বাহিনী। ফলে প্রাণ বাঁচাতে চুল দাড়ি কেটে এবং বোরকা পরে চোরের বেশে পালনোর পথ খুঁজছে জঙ্গীরা। এতেই ষড়যন্ত্রকারীদের আশায় গুঁড়ে বালি। অর্থাৎ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøামিদির পুতিন আইএস তথা ষড়যন্ত্রকারীদের স্বপ্ন একের পর এক গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।

সন্ত্রাসী ও জঙ্গী কারা : জঙ্গীবাদের উত্থানে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার শান্তিপ্রিয় জনগন দিশেহারা। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও ঘটছে বিপূল প্রাণহানি। হামলাকারী হিসেবে যাদের নাম আসছে, জাতিতে তারা মুসলিম পরিবারের অভিশপ্ত সন্তান। এক শ্রেনীর বিপদগামী যুবকের মস্তিস্ক ধোলাই করে তাদেরকে রিক্রুট করা হচ্ছে। এরপর ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে তাদের বিপদগামী করা হয়। আইএস, তালেবান, আল কায়দা, বোকো হারাম কিংবা আনসার আল ইসলাম নামধারী জঙ্গীর নামের তালিকায় অন্য কোন ধর্মের কারো নাম পাওয়া যায়নি। আর এটাই হল ইসলাম বিরোধী ষড়যন্ত্রকারীদের বিরাট সফলতা। ফলশ্রুতিতে এখন মুসলমানরা নিজেরা নিজেদের রক্ত ঝরাচ্ছে।

প্রশ্ন হচ্ছে (১) ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য কোন্ কোন্ মুসলিম দেশ ইসলাম বিরোধী শক্তিকে সহযোগীতা করছে ?

( ২) জঙ্গীবাদ সৃষ্টিতে কারা আর্থিক সহযোগীতা দিচ্ছে ?
( ৩) ধর্মের কথা বলে কারা মুসলমান ও ইসলামের ক্ষতি করছে ?
( ৪) মুখে ইসরাইল বিরোধী কিন্তু বাস্তবে ইসরাইলের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে কারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ?
(৫) মিশরের নির্বাচিত গনতান্ত্রিক সরকার উৎখাতে কোন কোন মুসলিম দেশ স্বৈরাচারী জেনারেল আবদুল ফাত্তাহ আল সিসি সরকারকে শত শত কোটি ডলার ঘুষ দিয়েছে?
( ৬) তালেবান ও আল-কায়েদা গঠনে কারা অর্থ জুগিয়েছে ?
( ৭ ) আর্থিক দূর্বল মুসলিম দেশগুলোতে বিনিয়োগ না করে কারা পশ্চিমাদেশে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে কোন কোন দেশ ?

এসব বিষয় বিচার বিশ্লেষন করলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলমানদের দূ:খ দূর্দশার জন্য আসলে কারা দায়ী ? আমেরিকা, বৃৃটেন, ইসরাইল নাকি ইসলাম ও মুসলিম বিরোধী কতিপয় মুসলিম শাসক। শত্রুরা সব সময় তৎপর রয়েছে। কিন্তু মুসলমানরা শত্রুদের ফাঁদে পড়বে কেন ? মুসলমানদের কি বিবেক বুদ্বি নেই ? ভাল মন্দ কি বুঝার উপায় নেই ? কেন নিজেরা ফাঁদে পা রাখছে দিচ্ছে ?
সুতরাং অন্যের দোষ দিয়ে লাভ কি ? আমরা নিজেরাই নিজেদের সর্বনাশ করছি।

লেখক : সিনিয়র রিপোর্টার ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক