খোলা কলাম | তারিখঃ June 29th, 2016 | নিউজ টি পড়া হয়েছেঃ 594 বার

সবকিছুই ভাঙ্গা। ভাঙ্গনের ভেতরই বসবাস। ভাঙ্গা জানালা দিয়ে মরিচের কোটাটা পড়ে গেল। ভাঙ্গা দরজা খুলে, ভাঙ্গা গেইট পার হয়ে জানালা কাছে মরিচের কৌটাটার সঙ্গে একই রকমের একটা পিতলের চামচ। কিছুতেই চামচটা ফেলে আসতে মন সায় দিল না। আমি বিখ্যাত হলে চামচটা চলে যাবে কোন যাদু ঘরে।
বিয়ের ঠিক আট দিনের মাথায় আমার প্রেমিক স্বামী আমার গায়ে হাত তুললো। অপরাধ শেমাইয়ের পাতিলে পিতলের চামচ ডুবিয়ে রাখা। তারপর দেড় মাসের মাথায়। তারপর ……
মোট কতবার জানি না। ঠিক গুণে রাখিনি। যতবার সেমাই রান্না করেছি ততবারই অন্য চামচ ফেলে রেখে এই চামচটাই ডুবিয়ে রাখতাম। কি জানি রবি বাবুর চন্দরা কখন বুকের গহিনে বসতি গাড়লো টেরই পেলাম না। এটা খুব টের পেতাম সামান্য ভুলে এমনকি না করা অপরাাধেও সে আমাকে খুব মারতো।
চুলের মুঠি ধরে রান্না ঘরের মেঝেতে মাথা ঠুকতো। কান তাক করে কষে চড় দিত। হাত ধরে উল্টে দিত। এক সময় অজ্ঞান হয়ে যেতাম। বাপ বের হয়ে গেলে মেয়েটা আমার কাছে আসতো।
এর আগে আমার কাছে আসতে গেলেই মেয়েটাও বাপের মার খেতো। চামচটা কখন ভাঙ্গা বাসা থেকে বের হয়েছিল জানি না। কিন্তু আমি বের হলাম চৌদ্দ বছর পর। বিয়ের কাবিনের কাগজের মোড়কে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আর পারছিলাম না ডির্ভোস পেপারে স্বাক্ষর দিয়ে বড় করে একটা শ্বাস নিলাম। না, আজ আমার শ্বাসটা কোথাও আটকালো না।
তারপর যখনই সেমাই রাধি পিতলের চামচের অভাব টের পাই খুব। একই রকম চামচ বাজারে খুঁজেছি, পাইনি। পেলে এবার ডুবিয়ে রাখতাম না। চামচটার সঙ্গে কথা বলতাম। বাবাকে বলতে পারতাম না। বাবা হাইপ্রেসারের রোগী ছিলেন।
চামচকে বলতা তুইতো জানিস তোর কারণে আমি কত নিষ্ঠুরভাবে মার খেয়েছি। বলা হলো না। ডিভোর্সের ১০ বছর পর আবার সেই চামচ। এটা কী সেটাই ? এই চামচ ঠিক সেই চামচ না হলেও সেরকম ঘর, সেরকম স্বামীর অস্তিত্ব এখনও ঘরে। মেয়েরা মার খায়। সবার ঘরে এই পিতলের চামচ থাকে না তবে স্বামী থাকে।
স্বামীরা মারতে থাকে যে মেয়েগুলি চন্দরার মত নিজের সত্ত্বাকে হত্যা করে সমাজ নামের আত্মীয় স্বজন আর পরিচিত জনের ওপর অভিমান করে প্রতিদিন কয়েকদফা ফাঁসীর দড়ি গলায় পরে না। সমাজ ভাবে তারা সতী নারী, লক্ষ্মী নারী।
আর যারা ফাঁসীর রায় মানে না তারা হয়ে যায় ‘চরিত্রহীনা’ ‘নষ্ট মেয়ে মানুষ’। সংসার ভাঙ্গা মেয়েগুলির কেবল স্বামীর সংসার নয় আশপাশের অনেক সম্পর্কই ভেঙ্গে যায়। একা জীবিকা নির্বাহ করতে গিয়ে প্রতিটি পদে পদে টের পায় অপরিচিত-পরিচিত সবার অসহযোগিতা সঙ্গে বোনাস, অপবাদ।
রান্নাঘরের ট্যাপ ভাঙ্গা। পাইপ ভেঙ্গে পড়া পানিতে চামচটা ধুয়ে নিই। চোখের সমান্তরালে চামচটাকে তুলে ধরি। বলনা চামচ তুই কেন ঘর ছাড়লি ? অসংখ্য বার প্রশ্ন করেও জবাব মেলে না। দরজায় কড় নাড়ার শব্দ। ডাক পিও না। না আমার জন্য মাউন্ট ফুজি থেকে কোন আনিস প্রেমের চিঠি পাঠায়নি।
পাঁচশত টাকার চেক। ছেলের জন্য। ডিভোর্সের আগেই আমার ঘর থেকে আমাকে প্রাক্তন এবং পরিত্যক্ত স্বামী ফ্রীজ, টিভি, শো-কেস, ক্যামেরা যা ছিল সবই নিয়ে গেছে। নেয়নি কেবল বাচ্চা দু’টি। ওরা যে আমারই মাংশ পিন্ড। আমার মাংশের টুকরার পেছনে ব্যয় না করে নষ্ট সমাজের কত কত নষ্টামীতে অংশগ্রহণ করা যায় ! কলমের কালি এত দ্রুত ফুরিয়ে যায়।
কলম বানানোর মেশিন ভাঙ্গা মনে হয় ড্রয়ার টান দিতেই বড় একটা ইঁদুর বেরুল। ভাঙ্গা ড্রয়ারে আমার লেখাগুলি ইঁদুরের খাবার হয়ে যায়। আমার মন ভেঙ্গে যায়। ভাঙ্গা মন নিয়ে পাক্কা আড়াই বছর মামলা টেনে ছেলে মেয়ের জন্য বরাদ্দ হল ৫০০ করে ১০০০ টাকা। মেয়েরটা শেষ। ছেলে পাবে আঠার বছর বয়স পর্যন্ত।
বেতনের টাকা দিয়ে যে টাকা থাকে তা দিয়ে চাল কিনতে গিয়ে ওষধের টাকা থাকে না। ঔষধ কিনতে গেলে চাল। রাতে টিউশনি থেকে যখন ফিরি তখন অন্ধকারে বোরকার আড়ালে কোন নারী দেখি না। যাদের দেখি তাদের কেউ রাতের বেলায় আমার মত একা না।
নির্মাণাধীন চারতলা ভবনের ভেতর দিয়ে যখন অন্ধকারে হাঁটি তখন নিজের পায়ের আওয়াজে নিজেই ভয় পাই। ভুত প্রেত মানি না, তবু ভয়, পুরুষ মানুষের আতংক। নয় সংখ্যা লিখতে গিয়ে তিন তিন গুণে নয়টা প্রশ্ন করে ছাত্র তবু রাগতে পারি না। মাথায় হাত বুলিয়ে বলি বাবু লেখ। পরের বাবুকে যখন পরম মমতায় পড়াই আমার বাবু তখন পড়ার সময় অপচয় করে।
মেয়েটা ব্যস্ত থাকে ডিসের জমকালো বিলাসী প্রোগ্রামে। ডাক্তার বলে বাচ্চাদের ঘরে সময় দেন। স্কুলের পর দুইটা টিউশনি। তারপর ঘরের কাজ তার বাচ্চাদের গালাগালি করে কান্ত আমি ঘুমিয়ে পড়ি। এমনিতে ছাদে ওঠার সময় পাই না। স্বপ্নের ভেতর ভাঙ্গা সিঁড়ি ভেঙ্গে ছাদে উঠি। পানির টাংকি দু’টিই ভাঙ্গতেই মনে পড়ে ঘুমের ঔষধ খাওয়া হয়নি।
বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করে না। ঘুমন্ত অপুষ্ট সন্তানের ঘুম ভাঙ্গাতে ইচ্ছা করে না। সুইচ টা ভাঙ্গা। অসাবধান হলেই ইলেক্ট্রিক শর্ট। আলো জ্বালি। ঔষধ খাই। ঘরটা ভীষন ফাঁকা মনে হয়। একটা বিছানা ফাঁকা। চৌকিটা ভাঙ্গা।
আমার ভাঙ্গা বিছানা, আমার খালি বিছানার জন্য কাতর মানুষ গুলিকে গুণতে থাকি, যোগ করি, গুণ করি কোথাও একজনের ভেতরও একরত্তি নির্লোভ, সৎ ভালোবাসা খুঁজে পাই না। বাতি নিভিয়ে বারান্দায় বসি। বারান্দার গ্রিল ভাঙ্গা, এত এত ভাঙ্গনের ভেতর থেকেও আকাশ দেখি। ভাঙ্গা গলায় গুণগুণিয়ে গান ধরি ‘ভেঙ্গে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি……।
লেখক: শামা আরজু
নোয়াখালী
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
- কাজী অফিস নোয়াখালী চৌমুহনী
- চাটখিলের শাহাপুরে আওয়ামীলীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন
- বন্ধু জুতা সেলাই করছেন, পাশে বসে গল্প করছেন মাশরাফি
- গতকাল থেকে খালেদা জিয়ার জ্বর
- জেলা প্রশাসক ও সিভিল সার্জন সমন্বয়ে প্রকাশ্যে পানের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান !
- নোয়াখালীতে মহিলা বিষয়ক দপ্তরে জাতীয় পতাকা না করায় তদপ্ত সাপেক্ষে রাষ্ট্রীয় আইনে বিচার করার অনুরোধ
- নোয়াখালীতে পূজামন্ডপ পরিদর্শন ও অনুদান প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারী
- ব্র্যাক এর সহযোগীতায় নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে উঠান বৈঠক অনুষ্ঠিত
- মেডিকেল সেন্টার উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে শুরু, ভবিষ্যতে এটি নোবিপ্রবির আধুনিক হেলথ রিচার্স সেন্টারে উপনিত হবে – প্রফেসর ড. মোহাম্মদ ফারুক উদ্দিন
- বিআরটিএ নির্দেশনায় সুশৃঙ্খলভাবে পথ চলার আহবান করেন: জেলা প্রশাসক ও প্রকৌশলীগন
Leave a Reply