ছবি #জিকে রাহাত

ছবি #জিকে রাহাত

দিল্লি শাহী মসজিদের অনুকরণে নির্মিত নোয়াখালীর সোনাইমুড়ির বজরা শাহী মসজিদ।

সরকারি গেজেটে প্রত্নসম্পদ হিসেবে নোয়াখালী বজরা শাহী মসজিদের নাম থাকলেও এর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ। ফলে সৌন্দর্য হারাতে বসেছে দিল্লির শাহী মসজিদের অনুকরণে নির্মাণ করা ঐতিহাসিক নিদর্শনটি। অথচ ২৭৫ বছরের পুরনো মসজিদটি হয়ে ওঠেছে জেলার অন্যতম দর্শনীয় স্থান। এখানে প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে শত শত দর্শনার্থীর সমাগম হয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নোয়াখালী জেলা প্রশাসক বদরে মুনির ফেরদৌস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বর্তমানে মসজিদটির রক্ষণাবেক্ষণ চলছে শুধু স্থানীয় ও মুসল্লিদের সহযোগিতায়। তবে শিগগিরই সরকারিভাবে ঐতিহাসিক ওই মসজিদের সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’ তিনি জানান, মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে সোনাইমুড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করে থাকেন।

স্থানীয়দের মতে, মসজিদটিকে দেশের অন্যতম দর্শনীয় ও পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে অর্থনীতিতে এটি দারুণ ভূমিকা রাখবে।  বাসিন্দারা জানান, বজরা শাহী মসজিদে যাতে নির্বিঘ্নে দর্শনার্থীরা আসতে পারেন সে জন্য ঢাকা-নোয়াখালী সড়কের পাশ ঘেঁষে এখানে আসার যে সড়ক রয়েছে তা আরও প্রশস্ত করতে হবে। মসজিদটির ঐতিহ্য রক্ষায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ শিগগিরই যথাযথ উদ্যোগ নেবে-এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয় ও দর্শনার্থীদের।

জানা গেছে, প্রায় ২৭৫ বছর আগে তৎকালীন দিল্লির সম্রাট মুহাম্মদ শাহ্র আমলে রাজদরবার থেকে জমিদার আমান উল্যাহ্কে বজরাযোগে (পালযুক্ত কাঠের নৌকা) রাজ্য পরিদর্শনে পাঠানো হয়। সম্রাটের নির্দেশ ছিল যেখানে রাজ্য পরিদর্শন শেষ হবে, সেখানে যেন দিল্লি শাহী মসজিদের আদলে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। তাই জমিদার আমান উল্যাহ্ রাজ্য পরিদর্শন শেষে নোয়াখালীর সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরায় বসতি স্থাপন করেন। সেখানে একটি দিঘি খনন করে মাটি ভরাট করে দিল্লি শাহী মসজিদের আদলে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। যা ‘বজরা শাহী মসজিদ’ নামে খ্যাত। সোনাইমুড়ী উপজেলার ওই এলাকার নাম ‘বজরা’ নামকরণ হয় ‘বজরা নঙর’ থেকে।

১৭৪১ খ্রিষ্টাব্দে ৩০ একর জায়গাজুড়ে উঁচু পাড়যুক্ত একটি দিঘি খনন করা হয়। ওই দিঘির কিছু মাটি দিয়ে পশ্চিম পাশে জমিদার বসতি স্থাপন করেন। জমিদার বাড়িটি বর্তমানে সরকারের ভূমি অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বসতবাড়ির পূর্ব পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ নির্মাণ করা হয়। গম্বুজগুলো সুদৃশ্য মার্বেল পাথরে গড়া। প্রায় ১১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৭৪ ফুট প্রস্থ এবং ২০ ফুট উঁচু মসজিদকে মজবুত করার জন্য মাটির ২০ ফুট উঁচু থেকে ভিত তৈরি করা হয়। মসজিদে প্রবেশের জন্য রয়েছে তিনটি ধনুকাকৃতির দরজা। প্রবেশপথের উপরে রয়েছে কয়েকটি গম্বুজ। কেবলা দেয়ালে তিনটি কারুকার্য খচিত মিনার রয়েছে। শিলালিপি ও দেয়ালে খোদায় করা ফুল, লতাপাতাসহ বাহারি নকশা। যা দর্শনার্থীদের মন কেড়ে নেয়। আর মসজিদ এলাকার মনোরম পরিবেশ এবং সামনের দিঘি সবার মন ছুঁয়ে দেয়।

মসজিদের বর্তমান ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাছান সিদ্দিকী। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘মোঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহর বিশেষ অনুরোধে মক্কা শরীফের বাসিন্দা মাওলানা শাহ আবু বকর সিদ্দিকী ঐতিহাসিক এই মসজিদের প্রথম ইমাম নিয়োজিত হন। পর্যায়ক্রমে তাঁর ছয় বংশধর ইতোমধ্যে মসজিদের ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আমি সপ্তম ইমাম হিসেবে দায়িত্বরত আছি।’

জনশ্রুতি রয়েছে, এই মসজিদে কিছু মানত করলে তাতে ফল পাওয়া যায়। প্রতিদিনই এখানে লোকজন টাকা-পয়সা ও সিরনি দান করেন। প্রতি শুক্রবার দূরদূরান্ত থেকে বিপুলসংখ্যক নারী-পুরুষ এসে জুমার নামাজ আদায় করেন। অন্য ধর্মাবলম্বীরাও এখানে বিভিন্ন মানত করেন। নিত্যদিন সমাগম হয় শত শত দর্শনার্থীর।

১৯৮৯ সালের ২৯ নভেম্বর সরকারি এক গেজেটে প্রত্নসম্পদ হিসেবে মসজিদটির নাম ঘোষণা করা হয়। তবে কোনো সরকারি অনুদান ছাড়াই মুসল্লিদের দান-অনুদানে মসজিদটি পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন সংস্কার না হওয়ায় বর্ষায় মসজিদের দক্ষিণের গম্বুজ ছুঁইয়ে ভেতরে পানি ঢোকে। মুসল্লির অজু ও গোসলের জন্য খনন করা বিশাল দিঘিটিও প্রায় ভরাট হয়ে বিলে পরিণত হয়েছে।