Barisal-Elish-220160405025354

বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ আসতে এখনো বাকি বেশ কয়েক দিন। তবে এরই মধ্যে বরিশালের ইলিশের মোকামে লেগেছে বৈশাখী হাওয়া। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম এবং বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করেই এক শ্রেণির ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ইলিশ মজুদের ফলে মূলত এ মূল্য বৃদ্ধি বলে মনে করছেন সাধারণ ক্রেতারা।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলা বছরের শুরুর দিন ইলিশ ও পান্তা খাওয়া বাঙালির চিরচারিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। বছরের অন্যান্য দিনগুলো বাদ গেলেও অন্তত এই দিন সকলে চায় তাদের আয়োজনে স্থান পাবে পান্তা-ইলিশ। আর সামুদ্রিক ইলিশ লবণাক্ত হওয়ায় বরিশাল অঞ্চলের মিঠা পানির রূপালি ইলিশের কদর একটু বেশি। তাই বরিশাল অঞ্চলের ইলিশের চাহিদা সারা বছর সারাদেশে। দেশের বাইরেও রয়েছে এর খ্যাতি। আর এ কারণেই বরিশালের ইলিশের বাজার সব সময় চড়া। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পহেলা বৈশাখের উত্তাপ।

বরিশালের বাইরে থেকেও অনেকে আসতে শুরু করেছেন পহেলা বৈশাখের অনুসর্গ হয়ে ওঠা পান্তা ইলিশের ইলিশ সংগ্রহ করতে। সব মিলিয়ে বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডের ইলিশ মোকামে লেগেছে বৈশাখী হাওয়া। নববর্ষ যত এগিয়ে আসছে, মোকামে কমছে ইলিশের সরবরাহ। যে পরিমাণ ইলিশ আসছে তার দুই-তৃতীয়াংশ প্যাকেটজাত হয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পাঠাচ্ছেন আড়তদাররা। বরিশাল মোকামের আড়তদাররাও গোপন স্থানে প্যাকেট মজুদ করে রাখছেন। একই অবস্থা দক্ষিণের অন্য দুটি ইলিশ মোকাম পটুয়াখালীর মহীপুর এবং বরগুনার পাথরঘাটায়। ফলে সরবারহ সংকটের অজুহাতে প্রতি দিনই ইলিশের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। ৩০ চৈত্র পর্যন্ত এ অবস্থা অব্যাহত থাকবে বলে ইলিশ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী ও মৎস্য শ্রমিকরা জানান।

বরিশাল মোকামে এক কেজি সাইজের ইলিশের কেজি বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার থেকে ৩২শ টাকার মধ্যে। বিগত বছরগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, নববর্ষের ২/১ দিন ওই সাইজের ইলিশের কেজি ৪ হাজার টাকা অতিক্রম করবে।

সরেজমিনে বরিশাল মোকামে গিয়ে দেখা যায়, সীমিত পরিমাণ ইলিশের কেনা-বেচা হচ্ছে সেখানে। ক্রয় করা ইলিশ ককশিটে বরফ দিয়ে প্যাকেটজাত করছেন শ্রমিকরা। প্রতিটি আড়তঘরের সামনে শত শত ককশিট প্যাকেটের স্তুপ করে রাখা হয়েছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই প্যাকেট ঢাকা পাঠানো হবে। নববর্ষ উৎসবে ঢাকায় ইলিশের চাহিদা আকাশচুম্বি। মূল্য পাওয়া যায় অনেক বেশি। ঢাকার আড়তদারদের চাহিদা অনুযায়ী বরিশালের আড়তদাররা প্যাকেটজাত করে প্রতিরাতে ট্রাকে ঢাকায় ইলিশ পাঠাচ্ছেন।

মোকামে ইলিশের সরবরাহ কম হওয়া প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা জানান, নদীর মধ্যে ট্রলারেই ইলিশ কেনা-বেচা সম্পন্ন হয়ে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ট্রলার যোগে ঢাকায় চলে যাচ্ছে। এ কারণে মোকামে ইলিশের আমদানি খুব কম।

মোকামের ইজারাদারের নিযুক্ত টোল আদায়কারী মো. কুদ্দুুসের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহ ধরে ইলিশের সরবরাহ কমে গেছে। এক সপ্তাহ আগে প্রতিদিন গড়ে দেড়শ’ মণ ইলিশের সরবরাহ হতো বরিশাল মোকামে। এখন ৫০মণের বেশি ইলিশ আসছে না। সরবরাহ কমায় দামও বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সোমবার মোকামে পাইকারি দর ছিল সোয়া কেজি থেকে দেড় কেজির বড় সাইজের ইলিশের মণ ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজি ইলিশের পাইকারি দাম পড়ে ৪ হাজার টাকা। তবে এ সাইজের ইলিশের সরবরাহ হয় খুব কম। যে পরিমাণ আসে তার সবটুকুই প্যাকেটজাত করে ঢাকায় পাঠানো হয়।

এক কেজি সাইজের ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টাকায়। সে হিসেবে প্রতি কেজির দাম পড়েছে ২ হাজার ৬২৫ টাকা। খুচরা বাজারে ওই মাছ বিক্রি করা হয় ৩ হাজার থেকে ৩২শ’ টাকা কেজি দামে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে ৭শ থেকে ৮শ গ্রাম ওজনের ইলিশের। আড়তদাররা এ সাইজের ইলিশকে বলেন এলসি সাইজ। এক সপ্তাহ আগেও এ মাছের মণ ছিল ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকার মধ্যে। সোমবার মোকামে মণ বিক্রি হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম ২ হাজার টাকা। নববর্ষের আগে মণ লাখ টাকা অতিক্রম করবে বলে মোকামের ব্যবসায়ীরা জানান।

তারা জানান, নববর্ষ উৎসবে এক কেজির বেশি সাইজ থেকে এলসি সাইজ পর্যন্ত ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। বরিশালসহ মফস্বল এলাকায় এ মাছের ক্রেতা থাকে না। এসব সাইজের ইলিশ প্যাকেটজাত করে ঢাকায় পাঠানো হয়।

তাই মফস্বল শহরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির নববর্ষ উৎসবে পান্তার সঙ্গে ভরসা হচ্ছে ভ্যালকা ইলিশ। ৪০০-৫০০ গ্রাম ওজন সাইজের ইলিশকে স্থানীয় ভাষায় ভ্যালকা বলা হয় ইলিশ মোকামে। নববর্ষ যত এগিয়ে আসছে এর দামও সাধারণ মানুষের বাইরে চলে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ আগে ভ্যালকার মণ ছিল ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। সোমবার প্রকারভেদে ভ্যালকার মণ ছিল ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। সে হিসেবে প্রতি কেজির দাম ছিল সাড়ে ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ টাকা। খুচরা বাজারে আরও ২০০/৩০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হয়। এদিকে, শিকার ও বিক্রয় নিষিদ্ধ জাটকার (৯ ইঞ্চির কম সাইজ) মণও বিক্রি হয়েছে ৩০ হাজার টাকায়।

বরিশাল আড়তদার অ্যাসোশিয়েসনের সভাপতি অজিত কুমার দাস মনু জানান, বড় ইলিশ জেলেদের জালে ধরা পড়ছে না। ফলে মোকামে ইলিশের সরবরাহ শূন্যের কোঠায়। আড়তগুলোতে জাটকা বিক্রি হয় না। নিষিদ্ধ এ ব্যবসার সঙ্গে আড়তদাররা জড়িতও নয়। তবে অভিযোগ আছে, বরিশালের হিজলা ও মেহেন্দিগঞ্জ এবং ভোলার চরফ্যাশন সংলগ্ন মেঘনা থেকে প্রতিদিন শত শত মণ জাটকা নিধন করে জেলেরা। যাত্রীবাহী লঞ্চ ও ট্রলারে বেশির ভাগ জাটকা পাচার হচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ উত্তরবঙ্গে।

বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল দাস  জানান, অভয়াশ্রমগুলোতে জেলেরা মাছ শিকার করতে না পারায় বাজারে ইলিশের সরবরাহ কম। তবে মে মাসের শুরু থেকেই ইলিশের বাজার স্বাভাবিক হবে বলে প্রত্যাশা করেন তিনি। ইলিশের উৎপাদন বাড়ানো এবং সংরক্ষণে নানা পদক্ষেপ নিলেও দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে মৎস্য বিভাগের কোন ভূমিকা নেই বলে দাবি করেন তিনি।